দোররা |
রবিবার, ১৭ জুলাই ২০১১ লিংকন মাহমুদসালিশে উপস্থিত শ’ শ’ মানুষ। টানটান উত্তেজনা। উপস্থিত স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। গ্রাম্য মাতব্বররাও হাজির। অভিযুক্ত দু’বোন হাফিজা বেগম হ্যাপি ও সাঈদা বেগম এক কোণে দাঁড়িয়ে। সবার সামনে অভিযোগ পড়ে শোনানো হলো- ওরা আত্মহত্যায় প্ররোচনা দানকারী। হ্যাপির স্বামী হাসেম আলী গত ২৩শে জুন বিষপানে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু মাতব্বরদের অভিযোগ এটি আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত হত্যা। আর এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে হাসেম আলীর স্ত্রী হাফিজা বেগম হ্যাপি ও তার বোন সাঈদা বেগম। তাই ওদের শাস্তি একটাই- দোররা। সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করা হয় এ শাস্তি। এ নিয়ে তোলপাড় রংপুরের সর্বত্র। কিন্তু কেন এ সালিশ ও শাস্তি? অনুসন্ধানে জানা যায়, সালিশের নামে দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের ক্ষমতার দাপট আর স্বার্থ চরিতার্থ করছেন গ্রাম্য মাতব্বররা। অভাবের সংসারে স্বামী হারিয়ে ২ সন্তান নিয়ে হ্যাপি যখন চোখে অন্ধকার দেখছিলেন, তখন গ্রাম্য সালিশে মাতব্বররা তাকেই অপবাদ দেয়। তার কাঁধেই চাপিয়ে দেয় স্বামীর মৃত্যুর দায়। সালিশ বৈঠকে তার ওপর নেমে আসে আরেক দুর্যোগ। গত ২৬শে জুন দুপুরে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রাজারামপুর কাশীগঞ্জ গ্রামে প্রকাশ্যে এই সালিশ বসে। সালিশের মধ্যে অসহায় দুই নারীকে চরিত্রহীনা অপবাদ দিয়ে তাদের হাত-পা বাঁধা হয়। শ’ শ’ মানুষের সামনে তাদের ওপর চালানো হয় মধ্যযুগীয় নির্যাতন। নির্যাতনের পর তাদের তওবা পড়ানো হয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আয়নাল হকের উপস্থিতিতেই ঘটে এ ঘটনা। কিন্তু বিচার নামে চালানো এ পৈশাচিক নির্যাতনের কেউ প্রতিবাদ করেনি। বরং উল্লাসে ফেটে পড়ে অনেকে দিয়েছে হাততালি। নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করার পর যে যার মতো পরিতৃপ্ত মনে চলে গেছে বাড়ি। কিন্তু নির্যাতিত ওই দুই বোন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে এখনও পড়ে আছে ঘরের অন্ধকার কোণে। তাদের চিকিৎসা নিতেও দেয়া হয়নি। সালিশে হ্যাপি ও সাঈদাকে কয়েক ঘণ্টা জেরা করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তারা অস্বীকার করেছেন। হ্যাপি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ২৩ তারিখ সকাল ১১টায় অভিমান করে বিষপান করেন তার স্বামী হাসেম আলী। এরপর তিনিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। দিনরাত জেগে স্বামীকে বাঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু দু’দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫শে জুন স্বামী মারা যান। এসব কথা বলে মাতব্বরদের হাত-পা ধরে অনেক কান্নাকাটি করেন হ্যাপি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। মন গলেনি মাতব্বরদের। সালিশ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় দু’বোনকে পেটাবে স্থানীয় মাতব্বর চিকনা এনামুল, মোটকা এনামুল ও হ্যাপির দূর সম্পর্কের ভাই আবদুল আউয়াল। সে অনুযায়ী প্রথমে দু’বোনের হাত-পা বাঁধা হয়। এরপর লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়। ৩ জন বলবান পুরুষের পিটুনিতে সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন অসহায় দু’বোন। কিন্তু ক্ষান্ত হননি মাতব্বররা। তাদের মাথায় পানি ঢালা হয়। সংজ্ঞা ফিরলে আবার দেয়া হয় পিটুনি। এরপর তাদের তওবা পড়ানো হয়। তওবা পড়ান স্থানীয় এহিয়াগঞ্জ দাখিল মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা সেকান্দর আলী। বিচারের রায় দেন চেয়ারম্যান আয়নাল হক। আর রায় কার্যকর করে আউয়াল, চিকনা এনামুল ও মোটকা এনামুল। এরপর ঘটনা যাতে প্রকাশ না হয় সে জন্য দু’বোনকে সাবধান করে তাদের কাছ থেকে সাদাকাগজে সই নেয়া হয়। এ ঘটনা যখন চলছিল তখন তো নয়ই পরেও পুলিশ রহস্যজনক কারণে নীরব থাকে। ঘটনার ১২ দিন পর এ বিষয়ে থানায় মামলা হয়। সে মামলা পুলিশ করেনি, করেছেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মামলার সময়ও আসামিদের পক্ষ নিয়েছে পুলিশ। নারী নির্যাতনের মামলা নেয়া হয়নি। মামলায় দণ্ডবিধির ৩২৩ ও ৩৫৪ ধারা বসানো হয়েছে যা জামিনযোগ্য। থানার ওসি’র বক্তব্য- পত্রিকা পড়ে তিনি ধারা বসিয়েছেন। তাই নারী নির্যাতনের ধারা বসানোর বিষয়টি তার মাথায় আসেনি। ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে নির্যাতনকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করেছে। তারা পুলিশের নীরব ভূমিকার প্রতিবাদ জানিয়ে মাতব্বরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার পর মাতব্বরদের ও চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কাউকেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। উল্টো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় নির্যাতিত দু’বোনকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। এমনকি চেয়ারম্যানের নির্দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলাও চালানো হয়েছে। গতকাল হ্যাপি ও সাঈদার সঙ্গে যোগাযোগ করেন আমাদের বদরগঞ্জ প্রতিনিধি রমজান আলী। হ্যাপি জানান, তার পায়ের ক্ষত শুকায়নি। তিনি এখনও হাঁটতে পারছেন না। স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও একটি এনজিও’র পক্ষ থেকে সামান্য সাহায্য পাওয়া গেছে। কিন্তু সেটা দিয়ে চিকিৎসা শেষ করা সম্ভব হয়নি। সাঈদা জানান, তার পায়ে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। ঘটনার পর থেকে তিনি ঘরেই পড়ে আছেন। কোন ধরনের চিকিৎসা নিতে পারেননি। তারা জানান, চেয়ারম্যান আয়নালের সাঙ্গপাঙ্গরা নিয়মিত তাদের হুমকি দিচ্ছে। নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন তারা। বদরগঞ্জ থানার ওসি তোবারক আলী বলছেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে চেয়ারম্যানসহ অন্য আসামিরা পলাতক থাকায় গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। তবে গ্রামবাসী বলছে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে আয়নাল চেয়ারম্যান, তার সহযোগী মাওলানা সেকান্দর আলীসহ অন্যরা। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, অবিলম্বে আসামিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে- যাতে আর কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজ করার সাহস না পায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এলিনা খান বলেন, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে এড়িয়ে বিচারের নামে এ ধরনের প্রহসন আইনের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। আর কোন তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই একতরফা ভাবে রায় দিয়ে দু’জন অসহায় নারীর ওপর নির্যাতন চালিয়ে মাতব্বররা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। ওদিকে এই ঘটনার সংবাদ কাভার করতে গেলে একুশে টেলিভিশনের অনুসন্ধানী দলের ওপর হামলা চালানো হয়। হামলায় আহত হন একুশে টিভি’র রংপুর প্রতিনিধি লিয়াকত আলী বাদল, রিপোর্টার জেমসন মাহবুব, ক্যামেরাম্যান এমএএইচ রাসেল। অভিযুক্ত আয়নাল চেয়ারম্যানের বক্তব্য নেয়ার জন্য সাংবাদিকরা তার বাড়ির দিকে যেতে চাইলে আয়নালের ক্যাডাররা একুশে টেলিভিশনের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়। তারা চালকের কাছ থেকে গাড়ির চাবি আর মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। পরে সাংবাদিকদের একটি বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে ঘণ্টাখানেক রাখার পর পুলিশ নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করে সাংবাদিকদের বদরগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা করা হয়। হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি হয় আয়নাল চেয়ারম্যান, মাওলানা সেকান্দর আলী ও তাদের সহযোগীরা। ঘটনা শোনার পর আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই রিপোর্ট প্রণয়নে ইটিভির সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন: বাংলাদেশে দোররা মেরে হত্যা চলছে মানবজমিন ডেস্ক: অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে আইন যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের হেনা আক্তারের ক্ষেত্রে আইন যথেষ্ট ছিল না। গত জানুয়ারিতে হেনাকে দোররা মেরে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ থেকে রেহাই পাওয়ার পর ১৪ বছরের হেনাকে ব্যভিচারী বলে অভিযোগ এনে স্থানীয় মাতবর এবং মৌলভীরা ১০০ ঘা দোররা মারার শাস্তি দেন। হেনার মা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছিলেন, ওই ঘটনার পর হেনা কথা বলতে পারতো না, কিছু খেতেও পারতো না। তার নাক, কান ও মুখ দিয়ে কেবল রক্ত বের হতো। দোররা মারার কয়েকদিন পরেই হেনার মৃত্যু হয়। গত ১১ই জুলাই অনলাইন টাইম ম্যাগাজিনে ‘জেন্ডার জাস্টিস: ইজ বাংলাদেশ ইগনোরিং ফতোয়া ভায়োলেন্স এগেইস্ট ওমেন?’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন এমিলি রাউহালা। তিনি আরও লিখেছেন, ওই ঘটনার পর কমপক্ষে তিন তরুণী একই ধরনের বর্বর এবং অবৈধ শাস্তির কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। এক বছর আগে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট নারীদের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত সহিংসতা দমনে এক নির্দেশ জারি করেছিল। দেশের আইনে নারী অধিকার রক্ষা করা হলেও স্থানীয় পরিষদ প্রতিনিয়তই তা লঙ্ঘন করছে। ফতোয়া সাধারণ ইসলাম সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই দিয়ে থাকেন। এর আওতায় শাস্তির মধ্যে জনসম্মুখে দোররা মারা থেকে শুরু করে মুখে কালি মাখা বা চুল কেটে দেয়ার শাস্তিও দেয়া হয়। স্থানীয় এনজিও ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ গত ১০ বছরে এ ধরনের শ’ শ’ ঘটনা নথিবদ্ধ করেছে। তারা এবং অন্য সংগঠনগুলো বলছে নারীদেরকে সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা করতে সরকার যথেষ্ট কাজ করছে না। অবশ্য এ চিত্র কেবল বাংলাদেশের একার নয়। সমপ্রতি ইউএন উইমেন প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী নারীরা প্রকৃতপক্ষে বিচারের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। উদাহরণ হিসেবে ইউএন উইমেন-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ১৩৯ অনুচ্ছেদে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে, ১১৭ অনুচ্ছেদে সম পারিশ্রমিক দেয়ার নির্দেশ রয়েছে এবং ১২৫ অনুচ্ছেদে পারিবারিক সহিংসতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরেও সমতা সুদূরপরাহত, পারিশ্রমিকে বৈষম্য রয়েছে আর নারীর ওপর সহিংসতা এখনও চলছে। হাফিংটন পোস্টে লেখা এক মতামত কলামে ইউএন উইমেনের প্রধান মিসেল ব্যাচলেট লিখেছেন- সমতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি আর তৃণমূল পর্যায়ে সেটা বাস্তবায়ন করা এক কথা নয়। দুঃখজনক হলেও নারীদের আইনগত অধিকারের নিশ্চয়তা এবং তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের ক্ষেত্রে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। এ বিষয়টি আমাদেরকে আবার বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশের বার্ষিকী পালন উপলক্ষে বাংলাদেশের কয়েকটি নামী এনজিও সহিংসতা এবং অপমানকে বৈধতা দিতে ফতোয়ার ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরকারকে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছে। তারা স্কুল-কলেজ এবং মাদরাসাতে গণশিক্ষা প্রচারণা চালানোর আহ্বানের পাশাপাশি নির্যাতিত নারীদেরকে আইনগত, আর্থিক এবং মানসিক সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের সমীক্ষাতে দেখা গেছে, বুরুন্ডিতে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ তাদের অবস্থান উন্নত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আশা করি বাংলাদেশও এ লক্ষ্যে একই পথ অনুসরণ করবে। |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন