গুলিস্তানে শহীদ মতিউর পার্কনেই পরিচর্যা, পরিণত হয়েছে মাদকসেবীদের অভয়ারণ্যে লিংকন মাহমুদ রাজধানীর পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো এখন অপরাধী চক্রের দখলে। মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী এবং ছিন্নমূল মানুষের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে নগরীর বিনোদন আশ্রয়গুলো। এদের অবাধ বিচরণের কারণে বিনোদন স্পটগুলোতে দর্শনার্থী কমে যাচ্ছে। রাজধানীর গুলিস্তানে শহীদ মতিউর পার্কের অবস্থা ভিন্ন কিছু নয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবঘুরে, পতিতা ও নেশাখোররা যেন পার্কটিকে বসতবাড়ি বানিয়েছে। কেউ ঘুমাচ্ছে, আবার কেউ সিরিঞ্জ দিয়ে শরীরে নেশাজাতীয় ইনজেকশন নিচ্ছে। এদিকে পার্কটির পাশেই নামাজের জন্য দুটি মসজিদ থাকলেও দখলদারদের কারণে মসজিদের ভেতর চলছে অফিসের কাজ। গুলিস্তান পাতাল সড়ক মার্কেট সমিতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃহ হচ্ছে ওই কার্যালয়টি। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই এ কার্যালয়টি মসজিদের ঠিক মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে। দৃশ্যত এখানে সিটি করপোরেশনের আধিপত্য থাকলেও দিন দিন অপরাধী চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পার্কের চারদিকে অবৈধ ছোট-বড় দোকানের অভাব নেই। আর এসব দোকান থেকে মাসিক ভাড়াও নিয়ে থাকে একটি চক্র। এদের ইশারায় এখানে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী মাদকচক্র। পার্কের মধ্যে সুন্দর পরিকল্পিত কোনো গাছ না থাকায় এটাকে পার্ক বললেও ভুল হবে। কয়েকটি বড় গাছ ছাড়া পার্কের সব অংশ ফাঁকা হওয়ায় তীব্র রোদ ও বৃষ্টির সময় ব্যাপক সমস্যায় পড়ে দর্শনার্থীরা। বৃষ্টির সময় আশ্রয়ের জন্য এখানে কোনো সুব্যবস্থা রাখা হয়নি। এই পার্কটি ঘিরে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সিটি করপোরেশন।
পার্কটির একমাত্র পুকুরের বেহালদশা
পার্কটি সিটি করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হলেও তাদের অবহেলা আর অমনোযোগিতার ফলে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে পার্কের ভেতরকার পুকুরটি। নানা রকম পানীয়ের বোতল ভেসে থাকতে দেখা যায় পুকুরে। বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা পুকুরের পাড়গুলো নষ্ট করে ফেলেছে। এর ফলে পানির রং ও স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। পানি থেকে গন্ধ এলেও এখানকার কর্মচারীরা নষ্ট পানিতে গোসল করতে বাধ্য হচ্ছে। সাধারণ মানুষ উপকৃত না হলেও দিন দিন কেন পুকুরের এতটা অবনতি, তার যথাযথ উত্তর দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। গুলিস্তানের মধ্যে এই জায়গাটিতে বড় একটি পুকুর থাকলেও তা থেকে উপকৃত হচ্ছে না জনসাধারণ। পুকুরের পাড় দিয়ে রয়েছে হাঁটা পথ এবং বসার ব্যবস্থা। এ পুকুরটি মতিউর পার্কের সৌন্দর্যেরও একটি অংশ। কিন্তু ধীরে ধীরে পুকুরটি হয়ে পড়ছে বিবর্ণ। পরিণত হতে যাচ্ছে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন এবং দুর্গন্ধযুক্ত পানির একটি পুকুরে। লেকের পাড়ে বসলে আগে পাওয়া যেত নির্মল-সতেজ-বিশুদ্ধ বাতাস। এখন সেখানে বসতে হয় নাকে রুমাল চেপে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের অভাবে পুকুরপাড় পরিণত হয়েছে জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ে। সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করছে ভবঘুরে, হকার, ভিক্ষুক, এমনকি পার্কের দর্শনার্থীরাও, যা মিশে যাচ্ছে লেকের পানিতে। আবার পার্কের গাছগুলোর শুকনো ডালপালা, পাতা ইত্যাদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলা হয়েছে লেকের পানিতে। ধীরে ধীরে এসব ডালপালা, ছন ইত্যাদি পচে পুকুরের পানি দূষিত করছে। পুকুরের পানির রং হয়ে পড়ছে কালো। পার্কের ময়লা-আবর্জনা এনে ফেলা হচ্ছে পুকুরের মধ্যে। আবর্জনা ফেলায় ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে লেকটি। বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট, বোতল, কাগজ ইত্যাদি ডাস্টবিনে না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেলে দেয় অনেকেই, যা শেষ পর্যন্ত পুকুরে গিয়েই পড়ে। ভাসমান হকারদের থেকে ব্যবহৃত টিস্যু, বোতল, প্যাকেট ইত্যাদি পুকুরের পানিতেই বেশি ফেলা হয়। পার্কের দর্শনার্থীদের এগুলো ফেলতে নিষেধ করারও কেউ নেই। এ ছাড়া পুকুরের কয়েকটি স্থানে দেখা গেছে কচুরিপানার আধিক্য, যা নিয়ন্ত্রণ না করা হলে ছড়িয়ে পড়বে পুরো পুকুরে। পার্কের এক কর্মচারী জানান, হকার-ভবঘুরে-ভিক্ষুকদের বের করে দিলেও এরা আবার চলে আসে। এ ছাড়া যারা পার্কে আসে, তারাও ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলে। তাদেরও সচেতন হওয়া উচিত। পার্কে বিকেলবেলা ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মাহমুদ জানান, পার্কটির একমাত্র পুকুরের সেই টলটলে পানি আর নেই। আগে পুকুরপাড়ে বসে বুক ভরে সতেজ, বিশুদ্ধ শ্বাস নেওয়া যেত। কিন্তু এখন তা কল্পনা। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ চরম উদাসীন। তাদের অবহেলা ও উদাসীনতায় পুকুরের এই করুণ অবস্থা। কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে দর্শনার্থীদেরও। পার্ক এবং পুকুরের সৌন্দর্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। পার্কগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবুজ ও সুন্দর ঢাকা গড়তে এগুলো রক্ষা করা অতি জরুরি।
ছিনতাইকারী চক্র
পার্কটিতে আগতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে যে কেউ নতুন ঘুরতে এলে নানা রকম সমস্যায় পড়ে। শক্তিশালী মাদকচক্র ছাড়াও এখানে রয়েছে ছিনতাই ও চাঁদাবাজচক্র। ঘুরতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, 'প্রথম প্রথম পার্কে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আসতাম। এখন তারা আসতে চায় না। নগরবাসীর স্বার্থে একটি সুন্দর পরিবেশের জন্য কর্তৃপক্ষের উচিত দুর্গন্ধমুক্ত, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং নিরাপত্তা জোরদার করা। এখানে দিনেরবেলায়ও প্রায়ই চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।' এ পার্কে বেড়াতে আসা মতিউর রহমান জানান, কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে নির্ভয়ে মানুষ পার্কে আসতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সন্ধ্যা হলেই পার্কের চারপাশ মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসেবী ও পতিতাদের আস্তানা হয়ে ওঠে। তা ছাড়া গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা রকম মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়। এখানে যারা মাদক বিক্রি করে, তারা অনেকটা সন্ত্রাসী প্রকৃতির। পার্কের চারপাশ এসব সন্ত্রাসী দখলদার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা কী করব? তাদের আটক করে জেলে পাঠালে পরদিনই আবার এখানে দেখতে পাই।' সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলিস্তানের পাতাল সড়ক মার্কেট সমিতি ব্যবসায়ী সংগঠন হলেও পার্কটি ঘিরে এদের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। সমিতির অফিস সেক্রেটারি পরিচয়দানকারী এস এম মাসুমের বিরুদ্ধে এই এলাকার ফুটপাতের দোকান থেকে প্রকাশ্যে চাঁদা ওঠানোর বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে পার্কটি ঘিরে ভিক্ষুক, পাগল ছাড়াও মাদকসেবীদের নিয়মিত প্রকাশ্যে আড্ডা দিতে দেখা যায়। এদের কারণে দর্শনার্থীরা শুধু বিরক্তই হচ্ছে না, শারীরিকভাবে লাঞ্ছনারও শিকার হচ্ছে। সব মিলিয়ে এখানে আসা দর্শনার্থীরা ত্যক্ত-বিরক্ত। পার্কে বসবাস করা কিছু লোক অভাবের তাড়নায় চোরাকারবারি-মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষেও কাজ করছে বলে প্রমাণ রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, দিনেরবেলা প্রায়ই এরা পার্কের বিভিন্ন কোণে ঘুমিয়ে থাকে, আর রাত হলেই সিন্ডিকেটের হয়ে কাজে নেমে পড়ে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুল হক সুপন জানান, প্রশাসনের কঠোরতা না থাকায় নগরীর পার্কগুলো যেন মাদক ব্যবসায়ী, মাদকাসক্ত ও পতিতাদের দখলে চলে যাচ্ছে। তিনি আরো জানান, নগরের পার্কগুলোকে অপরাধীরা তাদের অপকর্মের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। ফলে দর্শনার্থীরা হারাচ্ছে বিনোদন কেন্দ্র। এসব পার্ককে অপরাধীদের হাত থেকে মুক্ত করতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারের ভূমিকাই পারে পার্কের সার্বিক পরিস্থিতি নিরাপদ আর মনোরম পর্যটন এবং বিনোদনের উপযুক্ত আশ্রয় বানাতে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা বলেন, 'নগরের পার্কগুলোর সৌন্দর্য রক্ষায় আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এখানে সচেতন মহলেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তবে মতিউর পার্কের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান। রাজধানীর পার্ক ও ফুটপাতের সমস্যাগুলো সম্পর্কে স্বয়ং সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা কয়েক দিন আগে তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেন, 'করপোরেশনের সহায়-সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদে সময়মতো পুলিশ পাওয়া যায় না। নগরজীবনকে সুশৃঙ্খল রাখতে আমাদের প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হয়। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে পুলিশ ফোর্স খুবই জরুরি। আবার ভিন্ন চিত্রও রয়েছে_অবৈধ উচ্ছেদ শেষ করে পুলিশ ফোর্স রাজারবাগ পেঁৗছার আগেই তা পুনর্দখল হয়ে যায়। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।' এই যেখানে মেয়রের বক্তব্য, সেখানে সহজেই আঁচ করা যায়, মাদক ব্যবসায়ী আর ছিনতাইকারী চক্র কত শক্তিশালী।
পার্কটির একমাত্র পুকুরের বেহালদশা
পার্কটি সিটি করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হলেও তাদের অবহেলা আর অমনোযোগিতার ফলে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে পার্কের ভেতরকার পুকুরটি। নানা রকম পানীয়ের বোতল ভেসে থাকতে দেখা যায় পুকুরে। বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা পুকুরের পাড়গুলো নষ্ট করে ফেলেছে। এর ফলে পানির রং ও স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। পানি থেকে গন্ধ এলেও এখানকার কর্মচারীরা নষ্ট পানিতে গোসল করতে বাধ্য হচ্ছে। সাধারণ মানুষ উপকৃত না হলেও দিন দিন কেন পুকুরের এতটা অবনতি, তার যথাযথ উত্তর দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। গুলিস্তানের মধ্যে এই জায়গাটিতে বড় একটি পুকুর থাকলেও তা থেকে উপকৃত হচ্ছে না জনসাধারণ। পুকুরের পাড় দিয়ে রয়েছে হাঁটা পথ এবং বসার ব্যবস্থা। এ পুকুরটি মতিউর পার্কের সৌন্দর্যেরও একটি অংশ। কিন্তু ধীরে ধীরে পুকুরটি হয়ে পড়ছে বিবর্ণ। পরিণত হতে যাচ্ছে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন এবং দুর্গন্ধযুক্ত পানির একটি পুকুরে। লেকের পাড়ে বসলে আগে পাওয়া যেত নির্মল-সতেজ-বিশুদ্ধ বাতাস। এখন সেখানে বসতে হয় নাকে রুমাল চেপে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের অভাবে পুকুরপাড় পরিণত হয়েছে জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ে। সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করছে ভবঘুরে, হকার, ভিক্ষুক, এমনকি পার্কের দর্শনার্থীরাও, যা মিশে যাচ্ছে লেকের পানিতে। আবার পার্কের গাছগুলোর শুকনো ডালপালা, পাতা ইত্যাদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলা হয়েছে লেকের পানিতে। ধীরে ধীরে এসব ডালপালা, ছন ইত্যাদি পচে পুকুরের পানি দূষিত করছে। পুকুরের পানির রং হয়ে পড়ছে কালো। পার্কের ময়লা-আবর্জনা এনে ফেলা হচ্ছে পুকুরের মধ্যে। আবর্জনা ফেলায় ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে লেকটি। বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট, বোতল, কাগজ ইত্যাদি ডাস্টবিনে না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেলে দেয় অনেকেই, যা শেষ পর্যন্ত পুকুরে গিয়েই পড়ে। ভাসমান হকারদের থেকে ব্যবহৃত টিস্যু, বোতল, প্যাকেট ইত্যাদি পুকুরের পানিতেই বেশি ফেলা হয়। পার্কের দর্শনার্থীদের এগুলো ফেলতে নিষেধ করারও কেউ নেই। এ ছাড়া পুকুরের কয়েকটি স্থানে দেখা গেছে কচুরিপানার আধিক্য, যা নিয়ন্ত্রণ না করা হলে ছড়িয়ে পড়বে পুরো পুকুরে। পার্কের এক কর্মচারী জানান, হকার-ভবঘুরে-ভিক্ষুকদের বের করে দিলেও এরা আবার চলে আসে। এ ছাড়া যারা পার্কে আসে, তারাও ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলে। তাদেরও সচেতন হওয়া উচিত। পার্কে বিকেলবেলা ঘুরতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মাহমুদ জানান, পার্কটির একমাত্র পুকুরের সেই টলটলে পানি আর নেই। আগে পুকুরপাড়ে বসে বুক ভরে সতেজ, বিশুদ্ধ শ্বাস নেওয়া যেত। কিন্তু এখন তা কল্পনা। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ চরম উদাসীন। তাদের অবহেলা ও উদাসীনতায় পুকুরের এই করুণ অবস্থা। কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে দর্শনার্থীদেরও। পার্ক এবং পুকুরের সৌন্দর্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। পার্কগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবুজ ও সুন্দর ঢাকা গড়তে এগুলো রক্ষা করা অতি জরুরি।
ছিনতাইকারী চক্র
পার্কটিতে আগতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে যে কেউ নতুন ঘুরতে এলে নানা রকম সমস্যায় পড়ে। শক্তিশালী মাদকচক্র ছাড়াও এখানে রয়েছে ছিনতাই ও চাঁদাবাজচক্র। ঘুরতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, 'প্রথম প্রথম পার্কে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আসতাম। এখন তারা আসতে চায় না। নগরবাসীর স্বার্থে একটি সুন্দর পরিবেশের জন্য কর্তৃপক্ষের উচিত দুর্গন্ধমুক্ত, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং নিরাপত্তা জোরদার করা। এখানে দিনেরবেলায়ও প্রায়ই চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।' এ পার্কে বেড়াতে আসা মতিউর রহমান জানান, কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে নির্ভয়ে মানুষ পার্কে আসতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সন্ধ্যা হলেই পার্কের চারপাশ মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসেবী ও পতিতাদের আস্তানা হয়ে ওঠে। তা ছাড়া গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা রকম মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়। এখানে যারা মাদক বিক্রি করে, তারা অনেকটা সন্ত্রাসী প্রকৃতির। পার্কের চারপাশ এসব সন্ত্রাসী দখলদার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা কী করব? তাদের আটক করে জেলে পাঠালে পরদিনই আবার এখানে দেখতে পাই।' সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলিস্তানের পাতাল সড়ক মার্কেট সমিতি ব্যবসায়ী সংগঠন হলেও পার্কটি ঘিরে এদের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। সমিতির অফিস সেক্রেটারি পরিচয়দানকারী এস এম মাসুমের বিরুদ্ধে এই এলাকার ফুটপাতের দোকান থেকে প্রকাশ্যে চাঁদা ওঠানোর বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে পার্কটি ঘিরে ভিক্ষুক, পাগল ছাড়াও মাদকসেবীদের নিয়মিত প্রকাশ্যে আড্ডা দিতে দেখা যায়। এদের কারণে দর্শনার্থীরা শুধু বিরক্তই হচ্ছে না, শারীরিকভাবে লাঞ্ছনারও শিকার হচ্ছে। সব মিলিয়ে এখানে আসা দর্শনার্থীরা ত্যক্ত-বিরক্ত। পার্কে বসবাস করা কিছু লোক অভাবের তাড়নায় চোরাকারবারি-মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষেও কাজ করছে বলে প্রমাণ রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, দিনেরবেলা প্রায়ই এরা পার্কের বিভিন্ন কোণে ঘুমিয়ে থাকে, আর রাত হলেই সিন্ডিকেটের হয়ে কাজে নেমে পড়ে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুল হক সুপন জানান, প্রশাসনের কঠোরতা না থাকায় নগরীর পার্কগুলো যেন মাদক ব্যবসায়ী, মাদকাসক্ত ও পতিতাদের দখলে চলে যাচ্ছে। তিনি আরো জানান, নগরের পার্কগুলোকে অপরাধীরা তাদের অপকর্মের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। ফলে দর্শনার্থীরা হারাচ্ছে বিনোদন কেন্দ্র। এসব পার্ককে অপরাধীদের হাত থেকে মুক্ত করতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারের ভূমিকাই পারে পার্কের সার্বিক পরিস্থিতি নিরাপদ আর মনোরম পর্যটন এবং বিনোদনের উপযুক্ত আশ্রয় বানাতে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা বলেন, 'নগরের পার্কগুলোর সৌন্দর্য রক্ষায় আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এখানে সচেতন মহলেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তবে মতিউর পার্কের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান। রাজধানীর পার্ক ও ফুটপাতের সমস্যাগুলো সম্পর্কে স্বয়ং সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা কয়েক দিন আগে তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেন, 'করপোরেশনের সহায়-সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদে সময়মতো পুলিশ পাওয়া যায় না। নগরজীবনকে সুশৃঙ্খল রাখতে আমাদের প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হয়। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে পুলিশ ফোর্স খুবই জরুরি। আবার ভিন্ন চিত্রও রয়েছে_অবৈধ উচ্ছেদ শেষ করে পুলিশ ফোর্স রাজারবাগ পেঁৗছার আগেই তা পুনর্দখল হয়ে যায়। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।' এই যেখানে মেয়রের বক্তব্য, সেখানে সহজেই আঁচ করা যায়, মাদক ব্যবসায়ী আর ছিনতাইকারী চক্র কত শক্তিশালী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন