সোমবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১১

বিদ্যালয়ে পড়াশোনা বিদ্যালয়েই ঘুম


বিদ্যালয়ে পড়াশোনা বিদ্যালয়েই ঘুম

পঞ্চগড় প্রতিনিধি | তারিখ: ০১-১১-২০১১

শিক্ষার্থীরা কুপিবাতি আর হারিকেনের আলোয় বারান্দায় পড়ছে। এরপর রাতের খাবার। তারপর সেখানেই ঘুম। আবার পরদিন ক্লাস। এই দৃশ্য পঞ্চগড় সদরের সীমান্তঘেঁষা রতনীবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাশের জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছে ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভিভাবকেরা।
২৯ অক্টোবর রাত নয়টায় ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, শিক্ষার্থীরা বারান্দায় দল বেঁধে পড়ছে। পঞ্চম শ্রেণীর ৩২ জন ছাত্রছাত্রী। পৃথক দুটি কক্ষে রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অভিভাবকেরা তিনবেলা খাবার পৌঁছে দিয়ে যান বিদ্যালয়ে। একজন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক পড়ান আর একজন নারী ছাত্রীদের সঙ্গে বিদ্যালয়ে রাত কাটান। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভিভাবকেরা চাঁদা দিয়ে এ দুজনের সম্মানীর ব্যবস্থা করেছেন। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষক ও ২৫০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে।
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেন, ‘বৃত্তি ও শতভাগ পাসের নিশ্চয়তার জন্য পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০৯ সাল থেকে এই উদ্যোগ নিয়েছি। এই উদ্যোগের ফলে গত বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ২৪ জন শিক্ষার্থীর সবাই প্রথম বিভাগে পাস করেছে। ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভিভাবকদের সঙ্গে সভা করে এবার গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। গ্রামের বেশির ভাগ অভিভাবক দরিদ্র হওয়ায় সন্তানদের জন্য বাড়িতে শিক্ষক রেখে আলাদাভাবে পড়ানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক অভিভাবক নিরক্ষর। তাঁরা নিজেরা সন্তানদের পড়াতে পারতেন না। এই কারণে রাতে পাঠদান শুরু করা।’
পঞ্চগড় এমআর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘এলাকার ছেলেমেয়েরা যেন ভালোভাবে পড়তে পারে, তাই রাতে পাঠদানে সহযোগিতা করছি।’ তিনি পড়াশোনার তদারক করেন। স্কুলে ছাত্রদের সঙ্গে রাতও কাটান। তিনি বলেন, দল বেঁধে পড়তে সুবিধা হয়। একে অন্যকে সহযোগিতা করতে পারে।
স্কুলের বারান্দায় কুপিবাতি দিয়ে পড়ছে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র মো. রুবেল ইসলাম। সে জানায়, বাবা কাউছার আলম রিকশাভ্যান চালান। হারিকেন কেনার সামর্থ্য নেই। রুবেলের মতো আরও অনেকে কুপিবাতির আলোয় পড়েন।
জান্নাতুল বেগম ও শিমু আকতার বলে, ‘আমরা বিদ্যালয়ের বারান্দায় দল বেঁধে পড়াশোনা করি। এতে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। একে অন্যের সহযোগিতা নিই। না পারলে স্যার শিখিয়ে দেন। পড়াশোনা শেষ করে রাত ১০-১১টার দিকে আমরা বিদ্যালয়ের দুটি আলাদা কক্ষে ঘুমিয়ে পড়ি। এ জন্য বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় কাঁথা-বালিশ নিয়ে এসেছি। এভাবে পড়তে খুব ভালো লাগছে।’
অভিভাবক ফয়জুল ইসলাম একজন রিকশাভ্যানের চালক। মেয়েকে রাতের খাবার দিতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘স্কুলে একপ্রকার বিনি পয়সায় শ্রম দিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের রাতে বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। আমরা অভিভাবকেরা খুবই খুশি।’
প্রধান শিক্ষক আফরোজা বেগম বলেন, বিদ্যালয়ে রেখে রাতে পাঠদানের ফলে প্রতিবছরই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাসের হার বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা ভালো নম্বর পেয়ে পাস করছে। গত বছর পর্যন্ত এ বিদ্যালয় থেকে ২০ জনের সবাই প্রথম বিভাগে পাস করেছে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার ইমাম বলেন, ‘এই বিদ্যালয়ের এমন উদ্যোগ খুবই ভালো। বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন