রাজনীতি করতে বাধ্য হচ্ছে ঢাবি শিক্ষাথীরা
লিংকন মাহমুদ, ঢাবি প্রতিনিধি
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী ৩টি অনুষদ ১২টি বিভাগ ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৬৬টি বিভাগ ও ৮টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। এখানে অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডিসহ মোট ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান এবং সুযোগ-সুবিধা দেশের অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে উন্নত হওয়ায় প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীর চাপ বাড়ছে। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে আবাসিক হলের সংখ্যাও।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য একটি ছাত্রনিবাস ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক হলসহ ১৪টি হল রয়েছে। মেয়েদের জন্য আছে চারটি হল ও একটি ছাত্রীনিবাস। তারপরও মিটছে না আবাসন সমস্যা। প্রতি বছর নতুন শিক্ষার্থী এবং বিভাগের সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি আবাসিক হল। মোট শিক্ষার্থীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশই হলে থাকতে পারছেন। আর বাকি দুই-তৃতীয়াংশ হলে উঠতে না পেরে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বাড়ি ভাড়া করে অথবা মেসে থেকে পড়াশোনা করছেন। প্রতি বছর আবাসন ব্যয় বাড়লেও বাড়ছে না আবাসন সুবিধা ।
এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে আবাসন ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছিল, যত সিট থাকবে ঠিক ততজন শিক্ষার্থীই ভর্তি করা হবে। সময়ের সাথে সাথে আইনও পরিবর্তিত হয়েছে। অন্যদিকে কয়েক দশক ধরে আবাসিক হলগুলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে। ফলে সিট বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।
আসন সংখ্যা কম হওয়ায় প্রতিনিয়ত নিম্নমানের খাবারসহ অন্যান্য হাজারো সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীদের। প্রতিটি হলের ডাইনিংয়ের খাবারের মান নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। হলগুলোতে খাবার সমস্যা ছাড়াও ছারপোকা, মশা-মাছি এবং রয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যা পড়ালেখার অনুকূল নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ইতিহাস বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী জানান, তিনবার আবেদন করেও হলে সিট পাইনি। শত সমস্যা থাকলেও বাধ্য হয়ে মেসে থাকছি। প্রভোস্ট আমাদের প্রতি আন্তরিক নন, তিনি রাজনৈতিক নেত্রীর কথায় উঠবস করতে সবসময় আন্তরিক থাকেন। আর রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা এ সুযোগে চালান সিটের বিনিময়ে রাজনীতি।
এসএম হলের ২য় বর্ষের এক ছাত্র ফোকাস বাংলাকে জানান, প্রায় দুই বছর বারান্দায় থাকার পর মাত্র আট দিন আগে রুমে উঠতে পারলাম।
জিয়া হলের রাফি জানান, আবাসন সংকট থাকলেও তার অনেকটাই রাজনৈতিক কারণে কৃত্রিমভাবে তৈরি। যদি হল প্রশাসন কঠোর হতো তবে এতটা আবাসন সংকটে ছাত্রদের পড়তে হতো না।
বঙ্গবন্ধু হলের এক ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে বাধ্য হয়ে রাজনীতি করছি। এর সম্পূর্ণ দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। প্রশাসন চাইলে এ সিট ব্যবসা বন্ধ করতে পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটকে পুঁজি করে শুধু সিট প্রদান করে 'সিটের বিনিময়ে রাজনীতি' নামক কর্মসূচি বিগত দুই দশক ধরেই চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলো। হলে উঠতে হলে শিক্ষার্থীদের কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী হতে বাধ্য করা হয়, এমন অভিযোগ প্রায় সব হলের ছাত্রদের। প্রথমে সিট না পেয়ে গণরুমে বা মসজিদে ওঠানো হয় এবং জুড়ে দেওয়া হয় অনেক শর্ত। যেমন ছাত্র সংগঠনের মিছিল করা, প্রতিদিন সকাল ও রাতে মিটিংয়ে বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকা, যে কোনো সময় ডাকলেই সাড়া দেওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, এমনকি কাউকে মারতে বললে তাকে মারধর করা ইত্যাদি।
আবাসন সংকটের চরমতম উদাহরণটি হলো 'গণরুম'। ঢাবিতে ২০ বছর আগেও গণরুমের অস্তিত্ব ছিল না। যে রুমটিতে সর্বসাকুল্যে ১০-১২ জন ছাত্র থাকতে পারে, সেখানে ২৫-৩০ জন ছাত্র ওঠানো হয় অথচ ছাত্রনেতারা একাই একটি রুমে থাকেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো হলেই আসন বণ্টনে হল প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা নেই। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর হলের আবাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ পায় ছাত্রলীগ। শুধু শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেওয়া, নথিপত্র প্রদান, রেজাল্টশিট সংগ্রহ, উৎসবে উত্তম ভোজ প্রদান, জরুরি কাগজে স্বাক্ষর-এই গুটিকয়েক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হল প্রশাসনের কার্যক্রম। নিয়ম অনুযায়ী সিট বরাদ্দ দেয় হল প্রশাসন কাগজে-কলমে। বাস্তবে নেতাদের অনুমতি ছাড়া হল কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ পাওয়া কোনো ছাত্র হলে উঠতে পারে না।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল: ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। আবাসিক ছাত্রের সংখ্যা ৪০৫, দ্বৈতাবাসিক ৪০০ এবং অনাবাসিক ছাত্রের সংখ্যা ১৫৩৪ জন। রাজনৈতিক কর্মী ছাড়া এ হলে সিট পায় না ছাত্ররা। হলের বারান্দাগুলো ভরে আছে খাট, লেপ-তোশক আর কাপড়চোপড়ে। হলের পূর্ব ব্লক ও পশ্চিম ব্ল¬ক বারান্দায় প্রায় তিন শতাধিক ছাত্র বাস করে। বারান্দায় নতুন করে কারো থাকার ব্যবস্থা করা একেবারেই অসম্ভব। এ হলে রয়েছে তিনটি গণরুম। ১১১৫৬ ও ১৫৯-এ রুম তিনটিতে ৯০ জন ছাত্র থাকছে। অথচ ছাত্রনেতারা ১৪২, ১৪০, ১৩৯ ও ২৫ নং রুমে ছয় জন থাকেন, যেখানে সুন্দরভাবে থাকতে পারতো ৩২ জন ছাত্র।
শহীদুল্লাহ হল: ১৯২১ সালে ঢাকা হল নামে প্রতিষ্ঠিত এই হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৮০০, দ্বৈতাবাসিক ৪২৫ এবং অনাবাসিক ১৩২২ জন। এ হলের গণরুম হলো এক্সটেনশন বিল্ডিং ১-এর ১১০২, ১১০৮ এক্সটেনশন বিল্ডিং ২-এর ২১০২, ২১০৩, ২১০৭, ২১১১, ২১১৪, ২১১৫ নম্বর কক্ষগুলো। এখানে খাবারের মান তুলনামূলক ভালো।
জগন্নাথ হল: ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জগন্নাথ হল। আবাসিক ছাত্র ১০৭২, দ্বৈতাবাসিক ৬৫০ এবং অনাবাসিক ৭২৮ জন। রাজনৈতিক নানা গ্র“পিংয়ে এ হলের সাধারণ ছাত্ররা সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকে।
ফজলুল হক মুসলিম হল: ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৬৩৬, দ্বৈতাবাসিক ১৩০ এবং অনাবাসিক ৭০০ জন। ফজলুল হক মুসলিম হলের ২০০৫ এবং ৩০০৪ নম্বর গণরুমের ১৬টি সিটে ৮০ জনকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতাদের কথা না মানলে মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। গণরুমে বসবাসকারী বেশ কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মাঝে মাঝে রুমে জায়গা না পেয়ে ছাদে ঘুমাতে যান।
জহুরুল হক হল: ১৯৫৭ সালে ইকবাল হল নামে প্রতিষ্ঠিত। এ হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৭২৫, দ্বৈতাবাসিক ৫৪৮ এবং অনাবাসিক ১১০৭ জন। জহুরুল হক হলের টিনশেড বিল্ডিংয়ের ৪, ২০ ও ২৪ নম্বর কক্ষ এবং এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের ১০১২, ১০১৩, ১০১৪, ৩০০১ ও ৪০০৯ নম্বর কক্ষগুলোকে গণরুমে পরিণত করা হয়েছে। এ হলের ছাত্রদেরও ছাত্রলীগ নেতার অনুগত থাকতে হয়। অন্যথায় প্রথমে স্থান হয় হাসপাতালের বেডে এবং পরে হলের বাইরের কোনো মেসে।
মাস্টারদা সূর্যসেন হল: ১৯৬৬ সালে জিন্নাহ হল নামে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৫৭৭, দ্বৈতাবাসিক ৪৯০ এবং অনাবাসিক ২৩৮৭ জন। এ হলের গণরুম হলো ১৭৯, ১৮০, ১৮১, ১৮২, ২০১/ক, ২২৬, ২২৬/ক, ৩২৬, ৩২৬/ক, ৩২৯, ৪০১, ৪০১/ক, ৩৪৯, ৪২৬, ৪২৬/ক, ৪৪৯ নম্বর কক্ষগুলো। এ হলে বারোমাসই রাজনৈতিক কোন্দল লেগেই থাকে।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল: ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্রের সংখ্যা ৫৪০, দ্বৈতাবাসিক ৭২০ এবং অনাবাসিক ১২৮০ জন। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের গণরুম হলো ২২৮, ৩২৮, ৪২৮, ৫২৮, ই-২, ই-৪, ই-৬, ই-৮, ই-১০, ৪৪৮, ৪/ক, ৫/ক, ৬/ক নম্বর কক্ষগুলো।
কবি জসীম উদ্দীন হল: ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৩৯৭, দ্বৈতাবাসিক ৩১০ এবং অনাবাসিক ছাত্রসংখ্যা ১০৭৯ জন। ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত গণরুম হলো ১৩১, ২০৮, ২১২, ২১৫,২২৭ ও ৩২৭ নম্বর কক্ষগুলো। এ হলের আবাসন সংকট খুব বেশি।
স্যার এএফ রহমান হল: ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্র ৬০২, দ্বৈতাবাসিক ১৩০ এবং অনাবাসিক ১১৭৮ জন। হলের ১০৩, ১০৫, ১০৮, ১১১, ১১৫, ৩০৮ ও ৩০৭ নম্বর কক্ষগুলোতে ছাত্ররা গাদাগাদি করে বসবাস করেন। এর মধ্যে ১০৫ নম্বর রুমে ৪৮ জন ছাত্র বাস করেন। হল ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত হলেও বর্তমানে হলের ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতারা হল নিয়ন্ত্রণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল: ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্র ৪৮৪, দ্বৈতাবাসিক ৩৬০ এবং অনাবাসিক ৩১৮৪ জন। ১০৯, ১১০, ১১১ নম্বর কক্ষগুলো হচ্ছে এ হলের গণরুম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল: ১৯৮৮ সালে হলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আবাসিক ছাত্র ৪১৫, দ্বৈতাবাসিক ৩১৫ এবং অনাবাসিক ২,১০০ জন। বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত গণরুম হলো ২০৯/ক, ৩০১/ক, ৪০১/ক, ৫০১/ক, ২১৩/ক, ৩১৩/ক, ৪১৩/ক ও ৫১৩/ক ।
অমর একুশে হল : ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৪৪১, দ্বৈতাবাসিক ১৩৭ এবং অনাবাসিক ৬৪৩ জন। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট এ হলের আবাসন সংকট চরম। এ হলে ও রাজনৈতিক নেতাদের দৌরাত্ম থেমে নেই।
স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হল : ১৯৬৬ সালে আর্ন্তজাতিক হোস্টেল নামে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২২ ও অনাবাসিক ৩ জন। যদিও এটি বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত বর্তমানে এ হলে শিক্ষকদের জন্যও বরাদ্দ দেয়া হয়।
রোকেয়া হল : ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রীসংখ্যা ১৪৯৭, দ্বৈতাবাসিক ৪৩০ এবং অনাবাসিক ৪৯২০ জন। খাবার ও অন্যান্য সমস্যা লেগেই থাকে। এ হলের গণরুম হলো সি-১, সি-২ ও ৩০৬ নম্বর কক্ষ।
শামসুন্নাহার হল : ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রীসংখ্যা ৬৮৮, দ্বৈতাবাসিক ৬১২ এবং অনাবাসিক ৫৮৪৫ জন। ১৪১, ২৪১, ৩৪১, ৪৪১ ও ৫৪১ এ পাঁচটি কক্ষ হলো এ হলের গণরুম।
বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল: ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রীসংখ্যা ৫৩৬, দ্বৈতাবাসিক ২৬৩ এবং অনাবাসিক ১৪৩২ জন। এ হলের গণরুম ১০৮, ১০৯ ও ১১০এ তিনটি কক্ষ। হলের এক্সটেনশনের কাজ শেষ হলেও ছাত্রীরা উঠতে পারেনি।
লিংকন মাহমুদ, ঢাবি প্রতিনিধি
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী ৩টি অনুষদ ১২টি বিভাগ ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৬৬টি বিভাগ ও ৮টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। এখানে অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডিসহ মোট ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান এবং সুযোগ-সুবিধা দেশের অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে উন্নত হওয়ায় প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীর চাপ বাড়ছে। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে আবাসিক হলের সংখ্যাও।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য একটি ছাত্রনিবাস ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক হলসহ ১৪টি হল রয়েছে। মেয়েদের জন্য আছে চারটি হল ও একটি ছাত্রীনিবাস। তারপরও মিটছে না আবাসন সমস্যা। প্রতি বছর নতুন শিক্ষার্থী এবং বিভাগের সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি আবাসিক হল। মোট শিক্ষার্থীর মাত্র এক-তৃতীয়াংশই হলে থাকতে পারছেন। আর বাকি দুই-তৃতীয়াংশ হলে উঠতে না পেরে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বাড়ি ভাড়া করে অথবা মেসে থেকে পড়াশোনা করছেন। প্রতি বছর আবাসন ব্যয় বাড়লেও বাড়ছে না আবাসন সুবিধা ।
এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে আবাসন ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছিল, যত সিট থাকবে ঠিক ততজন শিক্ষার্থীই ভর্তি করা হবে। সময়ের সাথে সাথে আইনও পরিবর্তিত হয়েছে। অন্যদিকে কয়েক দশক ধরে আবাসিক হলগুলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে। ফলে সিট বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।
আসন সংখ্যা কম হওয়ায় প্রতিনিয়ত নিম্নমানের খাবারসহ অন্যান্য হাজারো সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীদের। প্রতিটি হলের ডাইনিংয়ের খাবারের মান নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। হলগুলোতে খাবার সমস্যা ছাড়াও ছারপোকা, মশা-মাছি এবং রয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যা পড়ালেখার অনুকূল নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ইতিহাস বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী জানান, তিনবার আবেদন করেও হলে সিট পাইনি। শত সমস্যা থাকলেও বাধ্য হয়ে মেসে থাকছি। প্রভোস্ট আমাদের প্রতি আন্তরিক নন, তিনি রাজনৈতিক নেত্রীর কথায় উঠবস করতে সবসময় আন্তরিক থাকেন। আর রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা এ সুযোগে চালান সিটের বিনিময়ে রাজনীতি।
এসএম হলের ২য় বর্ষের এক ছাত্র ফোকাস বাংলাকে জানান, প্রায় দুই বছর বারান্দায় থাকার পর মাত্র আট দিন আগে রুমে উঠতে পারলাম।
জিয়া হলের রাফি জানান, আবাসন সংকট থাকলেও তার অনেকটাই রাজনৈতিক কারণে কৃত্রিমভাবে তৈরি। যদি হল প্রশাসন কঠোর হতো তবে এতটা আবাসন সংকটে ছাত্রদের পড়তে হতো না।
বঙ্গবন্ধু হলের এক ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে বাধ্য হয়ে রাজনীতি করছি। এর সম্পূর্ণ দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। প্রশাসন চাইলে এ সিট ব্যবসা বন্ধ করতে পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটকে পুঁজি করে শুধু সিট প্রদান করে 'সিটের বিনিময়ে রাজনীতি' নামক কর্মসূচি বিগত দুই দশক ধরেই চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলো। হলে উঠতে হলে শিক্ষার্থীদের কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী হতে বাধ্য করা হয়, এমন অভিযোগ প্রায় সব হলের ছাত্রদের। প্রথমে সিট না পেয়ে গণরুমে বা মসজিদে ওঠানো হয় এবং জুড়ে দেওয়া হয় অনেক শর্ত। যেমন ছাত্র সংগঠনের মিছিল করা, প্রতিদিন সকাল ও রাতে মিটিংয়ে বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকা, যে কোনো সময় ডাকলেই সাড়া দেওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, এমনকি কাউকে মারতে বললে তাকে মারধর করা ইত্যাদি।
আবাসন সংকটের চরমতম উদাহরণটি হলো 'গণরুম'। ঢাবিতে ২০ বছর আগেও গণরুমের অস্তিত্ব ছিল না। যে রুমটিতে সর্বসাকুল্যে ১০-১২ জন ছাত্র থাকতে পারে, সেখানে ২৫-৩০ জন ছাত্র ওঠানো হয় অথচ ছাত্রনেতারা একাই একটি রুমে থাকেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো হলেই আসন বণ্টনে হল প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা নেই। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর হলের আবাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ পায় ছাত্রলীগ। শুধু শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেওয়া, নথিপত্র প্রদান, রেজাল্টশিট সংগ্রহ, উৎসবে উত্তম ভোজ প্রদান, জরুরি কাগজে স্বাক্ষর-এই গুটিকয়েক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হল প্রশাসনের কার্যক্রম। নিয়ম অনুযায়ী সিট বরাদ্দ দেয় হল প্রশাসন কাগজে-কলমে। বাস্তবে নেতাদের অনুমতি ছাড়া হল কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ পাওয়া কোনো ছাত্র হলে উঠতে পারে না।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল: ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। আবাসিক ছাত্রের সংখ্যা ৪০৫, দ্বৈতাবাসিক ৪০০ এবং অনাবাসিক ছাত্রের সংখ্যা ১৫৩৪ জন। রাজনৈতিক কর্মী ছাড়া এ হলে সিট পায় না ছাত্ররা। হলের বারান্দাগুলো ভরে আছে খাট, লেপ-তোশক আর কাপড়চোপড়ে। হলের পূর্ব ব্লক ও পশ্চিম ব্ল¬ক বারান্দায় প্রায় তিন শতাধিক ছাত্র বাস করে। বারান্দায় নতুন করে কারো থাকার ব্যবস্থা করা একেবারেই অসম্ভব। এ হলে রয়েছে তিনটি গণরুম। ১১১৫৬ ও ১৫৯-এ রুম তিনটিতে ৯০ জন ছাত্র থাকছে। অথচ ছাত্রনেতারা ১৪২, ১৪০, ১৩৯ ও ২৫ নং রুমে ছয় জন থাকেন, যেখানে সুন্দরভাবে থাকতে পারতো ৩২ জন ছাত্র।
শহীদুল্লাহ হল: ১৯২১ সালে ঢাকা হল নামে প্রতিষ্ঠিত এই হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৮০০, দ্বৈতাবাসিক ৪২৫ এবং অনাবাসিক ১৩২২ জন। এ হলের গণরুম হলো এক্সটেনশন বিল্ডিং ১-এর ১১০২, ১১০৮ এক্সটেনশন বিল্ডিং ২-এর ২১০২, ২১০৩, ২১০৭, ২১১১, ২১১৪, ২১১৫ নম্বর কক্ষগুলো। এখানে খাবারের মান তুলনামূলক ভালো।
জগন্নাথ হল: ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জগন্নাথ হল। আবাসিক ছাত্র ১০৭২, দ্বৈতাবাসিক ৬৫০ এবং অনাবাসিক ৭২৮ জন। রাজনৈতিক নানা গ্র“পিংয়ে এ হলের সাধারণ ছাত্ররা সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকে।
ফজলুল হক মুসলিম হল: ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৬৩৬, দ্বৈতাবাসিক ১৩০ এবং অনাবাসিক ৭০০ জন। ফজলুল হক মুসলিম হলের ২০০৫ এবং ৩০০৪ নম্বর গণরুমের ১৬টি সিটে ৮০ জনকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতাদের কথা না মানলে মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। গণরুমে বসবাসকারী বেশ কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মাঝে মাঝে রুমে জায়গা না পেয়ে ছাদে ঘুমাতে যান।
জহুরুল হক হল: ১৯৫৭ সালে ইকবাল হল নামে প্রতিষ্ঠিত। এ হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৭২৫, দ্বৈতাবাসিক ৫৪৮ এবং অনাবাসিক ১১০৭ জন। জহুরুল হক হলের টিনশেড বিল্ডিংয়ের ৪, ২০ ও ২৪ নম্বর কক্ষ এবং এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের ১০১২, ১০১৩, ১০১৪, ৩০০১ ও ৪০০৯ নম্বর কক্ষগুলোকে গণরুমে পরিণত করা হয়েছে। এ হলের ছাত্রদেরও ছাত্রলীগ নেতার অনুগত থাকতে হয়। অন্যথায় প্রথমে স্থান হয় হাসপাতালের বেডে এবং পরে হলের বাইরের কোনো মেসে।
মাস্টারদা সূর্যসেন হল: ১৯৬৬ সালে জিন্নাহ হল নামে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৫৭৭, দ্বৈতাবাসিক ৪৯০ এবং অনাবাসিক ২৩৮৭ জন। এ হলের গণরুম হলো ১৭৯, ১৮০, ১৮১, ১৮২, ২০১/ক, ২২৬, ২২৬/ক, ৩২৬, ৩২৬/ক, ৩২৯, ৪০১, ৪০১/ক, ৩৪৯, ৪২৬, ৪২৬/ক, ৪৪৯ নম্বর কক্ষগুলো। এ হলে বারোমাসই রাজনৈতিক কোন্দল লেগেই থাকে।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল: ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্রের সংখ্যা ৫৪০, দ্বৈতাবাসিক ৭২০ এবং অনাবাসিক ১২৮০ জন। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের গণরুম হলো ২২৮, ৩২৮, ৪২৮, ৫২৮, ই-২, ই-৪, ই-৬, ই-৮, ই-১০, ৪৪৮, ৪/ক, ৫/ক, ৬/ক নম্বর কক্ষগুলো।
কবি জসীম উদ্দীন হল: ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৩৯৭, দ্বৈতাবাসিক ৩১০ এবং অনাবাসিক ছাত্রসংখ্যা ১০৭৯ জন। ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত গণরুম হলো ১৩১, ২০৮, ২১২, ২১৫,২২৭ ও ৩২৭ নম্বর কক্ষগুলো। এ হলের আবাসন সংকট খুব বেশি।
স্যার এএফ রহমান হল: ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্র ৬০২, দ্বৈতাবাসিক ১৩০ এবং অনাবাসিক ১১৭৮ জন। হলের ১০৩, ১০৫, ১০৮, ১১১, ১১৫, ৩০৮ ও ৩০৭ নম্বর কক্ষগুলোতে ছাত্ররা গাদাগাদি করে বসবাস করেন। এর মধ্যে ১০৫ নম্বর রুমে ৪৮ জন ছাত্র বাস করেন। হল ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত হলেও বর্তমানে হলের ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতারা হল নিয়ন্ত্রণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল: ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্র ৪৮৪, দ্বৈতাবাসিক ৩৬০ এবং অনাবাসিক ৩১৮৪ জন। ১০৯, ১১০, ১১১ নম্বর কক্ষগুলো হচ্ছে এ হলের গণরুম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল: ১৯৮৮ সালে হলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আবাসিক ছাত্র ৪১৫, দ্বৈতাবাসিক ৩১৫ এবং অনাবাসিক ২,১০০ জন। বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত গণরুম হলো ২০৯/ক, ৩০১/ক, ৪০১/ক, ৫০১/ক, ২১৩/ক, ৩১৩/ক, ৪১৩/ক ও ৫১৩/ক ।
অমর একুশে হল : ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রসংখ্যা ৪৪১, দ্বৈতাবাসিক ১৩৭ এবং অনাবাসিক ৬৪৩ জন। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট এ হলের আবাসন সংকট চরম। এ হলে ও রাজনৈতিক নেতাদের দৌরাত্ম থেমে নেই।
স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হল : ১৯৬৬ সালে আর্ন্তজাতিক হোস্টেল নামে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২২ ও অনাবাসিক ৩ জন। যদিও এটি বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত বর্তমানে এ হলে শিক্ষকদের জন্যও বরাদ্দ দেয়া হয়।
রোকেয়া হল : ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রীসংখ্যা ১৪৯৭, দ্বৈতাবাসিক ৪৩০ এবং অনাবাসিক ৪৯২০ জন। খাবার ও অন্যান্য সমস্যা লেগেই থাকে। এ হলের গণরুম হলো সি-১, সি-২ ও ৩০৬ নম্বর কক্ষ।
শামসুন্নাহার হল : ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রীসংখ্যা ৬৮৮, দ্বৈতাবাসিক ৬১২ এবং অনাবাসিক ৫৮৪৫ জন। ১৪১, ২৪১, ৩৪১, ৪৪১ ও ৫৪১ এ পাঁচটি কক্ষ হলো এ হলের গণরুম।
বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল: ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের আবাসিক ছাত্রীসংখ্যা ৫৩৬, দ্বৈতাবাসিক ২৬৩ এবং অনাবাসিক ১৪৩২ জন। এ হলের গণরুম ১০৮, ১০৯ ও ১১০এ তিনটি কক্ষ। হলের এক্সটেনশনের কাজ শেষ হলেও ছাত্রীরা উঠতে পারেনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন