মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০১১

পাবলিক ভার্সিটিগুলোতে আবাসন সমস্যা প্রকট

পাবলিক ভার্সিটিগুলোতে আবাসন সমস্যা প্রকট
লিংকন মাহমুদ,  ঢাবি প্রতিনিধি
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে চরম আবাসন সঙ্কট। মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ৪৫ ভাগ হলে থাকতে পারছে। বাকি ৫৫ ভাগেরই আবাসন সুবিধা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি সংসদের চলতি অধিবেশনেই পেস করা হবে।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সমস্যা প্রকট। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য দুটি পৃথক হল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) একটি ছাত্রী হল, যশোর, রংপুর এবং পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্যও হল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
ইউজিসির প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাত্র ৪৫ দশমিক ০৬ ভাগ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা নিশ্চিতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে বাস্তব এবং বিরাজমান আসল চিত্র আরও ভয়াবহ ও করুণ। আবাসন সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই আবাসন সঙ্কটকে পুঁজি করেই লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি গড়ে উঠেছে। সাধারণ ছাত্ররা ব্যবহৃত হচ্ছে। হলে থাকতে হলে তাদের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের মিছিলে যেতে হয়। না হলে সিট হারানোর পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক সপ্তাহে এ ধরনের ৬টি ঘটনা ঘটেছে। আর এতে নতুনভাবে সংযোজিত হলো শিক্ষক নির্যাতনও।
ইউজিসির তথ্যমতে, বিগত দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে এ অবস্থা। শিক্ষার্থীদের ক্রমাগত চাপে দিনে দিনে আবাসন সঙ্কটের হার বাড়ছেই। সূত্রমতে, শুধু শিক্ষার্থীই নয়, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আবাসন সঙ্কটও তীব্রতর হয়েছে। মোট শিক্ষকের মাত্র ২৪ ভাগ, ১৫ ভাগ কর্মকর্তা ও ১৪ ভাগ কর্মচারী এ সুবিধার আওতায় আছেন।
ইউজিসির রিপোর্ট মতে, ২০০৯ সালে দেশের ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে মাত্র শতকরা ৪৫ দশমিক ০৬ জন আবাসন সুবিধা পেয়েছেন। অবশ্য আগের বছরের তুলনায় এটা প্রায় ৩ ভাগ বেশি। তবে, বিগত দশ বছরে সুবিধার হার পৌনঃপুনিক বেড়েছেও প্রায় ১০ ভাগ। তবে এটি চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য। যেমন ২০০৫ সালে গড়ে ৩৩ জন পেয়েছিল এই সুবিধা। ২০০৪ সালে গড়ে ৩২ জন পেয়েছিলেন এই সুবিধা।
জানা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনটিতেই সময়মতো শিক্ষাবর্ষ সম্পন্ন হয় না। একটি ব্যাচ পাস করে বের হওয়ার আগেই অন্য একটি ব্যাচ নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি করানো হয়। ফলে অনাবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র সেশনজট, সময়মতো পরীক্ষা না হওয়া ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে পারছে না। এছাড়া ছাত্রনেতারা হল দখল করে রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগ নেতা রেজা সেকান্দার একা একটি রুম দখল করে আছে। অথচ ওই হলে একই ধরনের রুমে ৮ জন থাকে। তার ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে দুই বছর আগে। কয়েকদিন আগে তাকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রভোস্টকে গলাধাক্কা খেতে হয়েছে। শিক্ষক লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ ঢাবি শাখার সহ-সভাপতি অছাত্র রেজা সেকান্দার। এ ঘটনায় রেজা সেকান্দারসহ চার ছাত্রলীগ কর্মীকে হল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তারা হলেই থাকছে। এরকম ঢাবির ১৩টি ছাত্র হলের সব হলেই ছাত্রলীগের হাতে প্রায়ই শিক্ষক লাঞ্ছিত ও ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি হলেই ৫০ থেকে ৮০ কক্ষ রয়েছে ছাত্রলীগের সরাসরি দখলে। ধারাবাহিকভাবে সিট সঙ্কট বাড়ার এসবও অন্যতম কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করা জন্য শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে নিরাপত্তার কারণে ছাত্রীদের সুবিধা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হয়। ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে থাকার জন্য আশপাশে বাসা ভাড়াও মেলে না। বিষয়গুলো সরকারের নজরে আনা হবে বলে জানান তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সঙ্কটের বিষয়টি তাদের নজরে রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রীদের সুবিধা আগেভাগে নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে তারা শিগগিরই পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান তিনি।
সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম অবস্থা : ইউজিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবচেয়ে চরম সঙ্কটে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীও আবাসন সুবিধা পাচ্ছে না। অথচ এই ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এরপর সবচেয়ে কষ্টে আছে কুমিল্লা এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ওই দুইটিতে যথাক্রমে ১৮ ও ১৯ ভাগ আবাসন সুবিধার মধ্যে রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২, খুলনায় ২৬ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮ ভাগ শিক্ষার্থী পাচ্ছে এই সুবিধা। দেশের একমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে আবাসিক সঙ্কট প্রকট। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ ভাগ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে মাত্র ৪৮ ভাগ শিক্ষার্থী হলে থাকছে। দেশের একমাত্র উচ্চতর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭ ভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৮ ভাগ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৪ ভাগ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৯ ভাগ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা ভোগ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১ ভাগ শিক্ষার্থী থাকছে হলে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পেয়ে আসছিল। এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য কোনো আবাসিক সুবিধা নেই। বর্তমানে এর ১৭৯ ছাত্রী মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সংখ্যা আশাতীত হারে বাড়ছে। আবাসন সুবিধাবঞ্চিত বেশি ছাত্রীরা। তাদের টিভি রুম, মিলনায়তনে থাকতে হচ্ছে। বর্তমানে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাচ্ছে। এ দুটি হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
২০০১ সালে দেশের মাত্র ১২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৯২ হাজার ৩১২ জন। যার মধ্যে মাত্র ৩৭ হাজার ২৬৭ জন অর্থাত্ ৪০ দশমিক ৩৭ ভাগ ছাত্রছাত্রী আবাসিক সুবিধা পেয়েছে। গত ১০ বছরের ব্যবধানে সারাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১টিতে। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলো এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৮২ হাজার ২২৬ জন। এর মধ্যে মাত্র ৬০ হাজার ৪৫৪ জন আবাসন সুবিধা পাচ্ছে। যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ৪৫ দশমিক ০৬ ভাগ।
শিক্ষক-স্টাফদেরও সমস্যা : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন সঙ্কটও তীব্র। ইউজিসির ২০০৯ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ হাজার ২৪১ জন শিক্ষককের মধ্যে আবাসিক সুবিধা পেয়েছেন ২ হাজার ২৩৩ জন। যা মোট শিক্ষককের মাত্র ২৪ ভাগ। এছাড়া এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২ হাজার ৪৯৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। যাদের মাত্র ১৫ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী আবাসন সুবিধা ভোগ করছেন। ২০০৩ সালে ২৯ দশমিক ৮১ ভাগ শিক্ষক এবং ১৬ দশমিক ৪২ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী এ সুবিধার অধীন ছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন