নানা সমস্যায় জর্জরিত ঢাবির ছাত্রী হল
মেসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা
লিংকন মাহমুদ, ঢাবি প্রতিনিধি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে সমস্যার শেষ নেই। সীমাহীন সমস্যার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে এখানে শিক্ষার পরিবেশ। চরম সিট সংকটে ভুগছে ছাত্রীরা। নির্ধারিত সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি ছাত্রী অবস্থান করছে প্রতিটি রুমে। ডাইনিং থেকে সরবরাহ করা নিম্নমানের পচা-গলা খাবার তাদের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। তীব্র পানি সংকট ছাত্রীদের নিত্যসঙ্গী। বিদ্যমান হাজারো সমস্যার কারণে ৪টি ছাত্রী হল ও একটি হোস্টেলের সাড়ে ৯ সহস্রাধিক আবাসিক ছাত্রীর শিক্ষাজীবন নাজুক হয়ে পড়েছে। রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, কুয়েত মৈত্রী হল এবং বেগম ফজিলাতুন্নেসা হল ও নবাব ফয়জুন্নেসা ছাত্রী নিবাসে সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রীদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ তাদের হলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে। কি সমস্যা বা সম্ভাবনা এখানে রয়েছে, তারা লেখাপড়া করতে পারছে কি-না ইত্যাদি দেখার যেন কেউ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির আনুপাতিক হার সমান হলেও সুযোগ-সুবিধা থেকে পিছিয়ে রয়েছে ছাত্রীরা। যেখানে ছাত্রদের জন্য ১২টি আবাসিক হল সেখানে ছাত্রীদের জন্য রয়েছে মাত্র ৪টি আবাসিক হল। সঙ্গত কারণেই ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের সমস্যা বেশি।
ছাত্রীদের হলগুলোর মধ্যে প্রথমেই উলেস্নখযোগ্য ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের প্রথম ও সর্ববৃহৎ আবাসিক হল রোকেয়া হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ হলে ছাত্রী সংখ্যা ৬ হাজার ২শ' ২৪ জন উলেস্নখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬১৩ জন আবাসিক এবং ৪৬১১ জন অনাবাসিক ছাত্রী রয়েছে। কিন্তু এ হলে বর্তমানে বাস করছে প্রায় ৪ হাজার ছাত্রী।
হলের আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর এ হলে অধিভুক্ত হওয়া ৫ শতাধিক ছাত্রীর মধ্যে বহুছাত্রী প্রথমদিকে অনেকটা আত্মগোপন করে হলে বসবাস করে। স্থান সঙ্কুলানের অভাবে এ হলে নিউ বিল্ডিং'র নিচতলায় হল রুমটি গণরুম হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। যেখানে বাস করে ৬০ থেকে ৭০ জন ছাত্রী। এই হলে বিশাল বিল্ডিং ও একটি ফাঁকা মাঠ অযথা পড়ে আছে। মেধাস্কোর অনুযায়ী ছাত্রীদের আবাসন সুবিধা দেয়া হলেও অধিকাংশই লবিং-এর জোরে সিট পান বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রথমবর্ষের ছাত্রীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন শিক্ষকরা। হলের টয়লেটের খারাপ অবস্থা। গোসলখানার অবস্থাও করুণ। ডাইনিং ও ক্যান্টিনের ব্যবস্থা থাকলেও নেই কোন ফ্রিজ। যে কারণে একদিনের বাজার তিনদিন পর্যন্ত খেতে হয় ছাত্রীদের। হলে একটি সাইবার সেন্টার থাকলেও প্রতি ঘন্টার জন্য ছাত্রীদের পরিশোধ করতে হয় ১২ টাকা। পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক নেত্রীর চাপ। সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয় জুনিয়র ছাত্রীদের।
অবশ্য রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ সভাপতি নাসরীন খানম ইত্তেফাককে বলেন, হলে কোন ছাত্রীদের রাজনৈতিকভাবে চাপ দেয়ার প্রশ্নই আসে না। স্বাধীন ও ইচ্ছামতো হলে থাকছে ছাত্রীরা। তবে হলে থাকার বাড়তি সুবিধা থাকলেও অসুবিধাই বেশি। কারণ ছাত্রীর তুলনায় রুম কম। চার সিটের রুমে কমপক্ষে ৭-৮জন থাকতে হয়। অনেক সময় আরো বেশি ছাত্রীকে একসঙ্গে থাকতে হয়। প্রভোস্ট খোঁজ নেন না ছাত্রীদের। নোংরা ও নিম্নমানের খাবার খান ছাত্রীরা।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. লায়লা নূর ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী এ হল পরিচালনা করা হচ্ছে। হলে কোন সমস্যা নেই। সিটগুলো মেধার ভিত্তিতে দেয়া হয়। ছাত্রীদের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম ছাত্রী নিবাস শামসুন্নাহার হল। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী এ হলে ৭ হাজার ১৪৫ জন ছাত্রীর নামে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৬শ' ৮৮ জন আবাসিক, ৬শ ১২ জন দ্বৈতাবাসিক এবং ৫ হাজার ৮শ' ৪৫ জন অনাবাসিক। সব মিলিয়ে বর্তমানে এ হলে বাস করছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ছাত্রী। হলে বসবাসের জন্য রয়েছে মোট ৬টি গণরুম। এসব রুমের প্রতিটিতে ৩০-৩৫ জন করে ছাত্রী বসবাস করে।
হলের ছাত্রীরা জানান, হলের ১৪১, ২৪১, ৩৪১, ৪৪১ ও ৫৪১ নং রুমকে গণরুম করা হয়েছে। এই রুমগুলো রাজনৈতিক নেত্রীরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এছাড়াও হলের ১০২ নং রুমও মিনি গণরুম হিসাবে ব্যবহূত হচ্ছে। আগে ৮ সিটের এই রুমটি বিদেশী ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত থাকলেও এখন সাধারণ ছাত্রীদের বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। হলের বিশাল গেস্ট রুমের একপাশে করা হয়েছে সাইবার সেন্টার। সংকুচিত হয়েছে গেস্ট রুম। মাস্টার্সের ছাত্রীদেরও ডাবলিং করতে হয় ।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক নাজমা শাহীন ইত্তেফাককে বলেন, হলে ধারণ ক্ষমতার বেশি ছাত্রীকে সিট বরাদ্দ দেয়ার কারণে আবাসন সমস্যা রয়েছে। এ জন্য ডাবলিং'র ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল। এ হলে আবাসিক সিটের সংখ্যা ৫৩৬টি। দ্বৈতাবাসিক সিট ২৬৩। এছাড়াও অনাবাসিক ১ হাজার ৪৩২। এই হলের মোট ছাত্রীর সংখ্যা ২ হাজার ২৩১ জন। দ্বৈতাবাসিকসহ এ হলে বর্তমানে দেড় হাজারের অধিক ছাত্রী বসবাস করছে। এ হলে গণরুমের সংখ্যা ৪টি। প্রতিটি রুমে কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ জন ছাত্রী বসবাস করেন। হলের ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, আবাসন সংকট নিরসন করার লক্ষ্যে হলে শিকদার ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হলেও এটি এখন শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। হলে মশার উপদ্রব অনেক বেশি। হলের ছাত্রী আসমা বলেন, হলের দুইটা পড়ার রুম থাকলেও তাতে ৪০ জনের বেশি ছাত্রী পড়তে পারে না। রাত দেড়টার পরে হলের পড়ার রুম বন্ধ করে দেয়া হয়। এজন্য পরীক্ষার সময় গণরুমে বসবাসকারী ছাত্রীদের মারাত্মক সমস্যা হয়। মৈত্রী হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী বলেন, আমি প্রথম বর্ষের ছাত্রী হওয়ায় এখনো হাউজ-টিউটরদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানি না। তবে এতটুকুই বুঝি যে, তাদের অনেক 'পাওয়ার' আছে। অপর ছাত্রী সুবর্ণা বলেন, সমস্যায় জর্জরিত পুরো হল। ডাইনিংয়ে খাবার খেতে গেলে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। উচ্চদাম, নিম্নমানের খাবার। তাও আবার পরিমাণে এত কম যে, আগে না গেলে সে বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। সহস্রাধিক ছাত্রী হলে থাকলেও মাত্র ৩০ সিটের দুটি রিডিং রুম আছে হলে। হল লাইব্রেরিতে নেই পর্যাপ্ত এবং প্রয়োজনীয় বই।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ফরিদা বেগম ইত্তেফাককে বলেন, শিকদার ভবনটি ছাত্রীদের জন্য। তবে ছাত্রীদের তদারকি করার জন্য সহকারী আবাসিক শিক্ষকদের জন্য কিছু বাসা তৈরি করা হয়েছে। দেড়টার পর ছাত্রীরা পড়াশোনা করে না বলে রিডিং রুম বন্ধ রাখা হয়। তাদের অভিযোগ ঠিক নয়।
মেয়েদের সবচেয়ে ছোট হল হলো বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের ৫০৮টি সিটে বসবাস করছে প্রায় ১ হাজার ছাত্রী। হলে ৫টি গণরুম রয়েছে। এর মধ্যে মোহনা নামে একটি গণরুমে ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রী অবস্থান করে। এছাড়াও হলের ১১৯ থেকে ১২২ নং কক্ষ পর্যন্ত গণরুম রয়েছে। প্রতিটি গণরুমে ১৫ থেকে ২০ জন অবস্থান করে। এই হলে ডাইনিংয়ে খাবারের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। হলে বিনোদনের জন্য শুধু একটি টিভি রয়েছে। নেই কোন গেমস রুম। হল প্রভোস্ট ঠিকমতো হলে আসেন না বলে অভিযোগ করেন ছাত্রীরা। ছাত্রীরা বলেন, রুমে দুইটার বেশি কম্পিউটার রাখা যায় না।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক গুলশান আরা লতিফা ইত্তেফাককে বলেন, এখন সবচেয়ে বেশি খেলাধুলা হয় ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে। অন্য হলের চেয়ে এ হল অনেক এগিয়ে। প্রশাসন অনেকটা গতিশীল। খাবারের মান অনেক উন্নত হয়েছে।
ছাত্রীদের বড় একটি অংশ মেসে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয় মেসে। প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তারা। হলের সিট সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে তারা মেসে আশ্রয় নেন। তারপরেও তারা সবসময় থাকেন মানসিক দুশ্চিন্তায়। হলের বাইরে মেসে থাকা কেয়া বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে মেসে আছি। এখনো সিট পাই নি। কবে হলে উঠতে পারবো তার কোন ঠিক নেই।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ইত্তেফাককে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসন সংকটের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। কার্জন হলের পাশে রেলওয়ের জমিতে ১ হাজার আসনবিশিষ্ট ছাত্রী হলের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। শামসুন্নাহার ও জগন্নাথ হলের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ছাত্রী হল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও আরো একটি ছাত্রী হল নির্মাণের চিন্তা-ভাবনা চলছে। এই হলগুলো নির্মিত হলে ছাত্রীদের আবাসিক সংকট অনেকটা কমবে বলে তিনি জানান।
মেসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা
লিংকন মাহমুদ, ঢাবি প্রতিনিধি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে সমস্যার শেষ নেই। সীমাহীন সমস্যার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে এখানে শিক্ষার পরিবেশ। চরম সিট সংকটে ভুগছে ছাত্রীরা। নির্ধারিত সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি ছাত্রী অবস্থান করছে প্রতিটি রুমে। ডাইনিং থেকে সরবরাহ করা নিম্নমানের পচা-গলা খাবার তাদের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। তীব্র পানি সংকট ছাত্রীদের নিত্যসঙ্গী। বিদ্যমান হাজারো সমস্যার কারণে ৪টি ছাত্রী হল ও একটি হোস্টেলের সাড়ে ৯ সহস্রাধিক আবাসিক ছাত্রীর শিক্ষাজীবন নাজুক হয়ে পড়েছে। রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, কুয়েত মৈত্রী হল এবং বেগম ফজিলাতুন্নেসা হল ও নবাব ফয়জুন্নেসা ছাত্রী নিবাসে সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রীদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ তাদের হলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে। কি সমস্যা বা সম্ভাবনা এখানে রয়েছে, তারা লেখাপড়া করতে পারছে কি-না ইত্যাদি দেখার যেন কেউ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির আনুপাতিক হার সমান হলেও সুযোগ-সুবিধা থেকে পিছিয়ে রয়েছে ছাত্রীরা। যেখানে ছাত্রদের জন্য ১২টি আবাসিক হল সেখানে ছাত্রীদের জন্য রয়েছে মাত্র ৪টি আবাসিক হল। সঙ্গত কারণেই ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের সমস্যা বেশি।
ছাত্রীদের হলগুলোর মধ্যে প্রথমেই উলেস্নখযোগ্য ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের প্রথম ও সর্ববৃহৎ আবাসিক হল রোকেয়া হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ হলে ছাত্রী সংখ্যা ৬ হাজার ২শ' ২৪ জন উলেস্নখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬১৩ জন আবাসিক এবং ৪৬১১ জন অনাবাসিক ছাত্রী রয়েছে। কিন্তু এ হলে বর্তমানে বাস করছে প্রায় ৪ হাজার ছাত্রী।
হলের আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর এ হলে অধিভুক্ত হওয়া ৫ শতাধিক ছাত্রীর মধ্যে বহুছাত্রী প্রথমদিকে অনেকটা আত্মগোপন করে হলে বসবাস করে। স্থান সঙ্কুলানের অভাবে এ হলে নিউ বিল্ডিং'র নিচতলায় হল রুমটি গণরুম হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। যেখানে বাস করে ৬০ থেকে ৭০ জন ছাত্রী। এই হলে বিশাল বিল্ডিং ও একটি ফাঁকা মাঠ অযথা পড়ে আছে। মেধাস্কোর অনুযায়ী ছাত্রীদের আবাসন সুবিধা দেয়া হলেও অধিকাংশই লবিং-এর জোরে সিট পান বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রথমবর্ষের ছাত্রীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন শিক্ষকরা। হলের টয়লেটের খারাপ অবস্থা। গোসলখানার অবস্থাও করুণ। ডাইনিং ও ক্যান্টিনের ব্যবস্থা থাকলেও নেই কোন ফ্রিজ। যে কারণে একদিনের বাজার তিনদিন পর্যন্ত খেতে হয় ছাত্রীদের। হলে একটি সাইবার সেন্টার থাকলেও প্রতি ঘন্টার জন্য ছাত্রীদের পরিশোধ করতে হয় ১২ টাকা। পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক নেত্রীর চাপ। সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয় জুনিয়র ছাত্রীদের।
অবশ্য রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ সভাপতি নাসরীন খানম ইত্তেফাককে বলেন, হলে কোন ছাত্রীদের রাজনৈতিকভাবে চাপ দেয়ার প্রশ্নই আসে না। স্বাধীন ও ইচ্ছামতো হলে থাকছে ছাত্রীরা। তবে হলে থাকার বাড়তি সুবিধা থাকলেও অসুবিধাই বেশি। কারণ ছাত্রীর তুলনায় রুম কম। চার সিটের রুমে কমপক্ষে ৭-৮জন থাকতে হয়। অনেক সময় আরো বেশি ছাত্রীকে একসঙ্গে থাকতে হয়। প্রভোস্ট খোঁজ নেন না ছাত্রীদের। নোংরা ও নিম্নমানের খাবার খান ছাত্রীরা।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. লায়লা নূর ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী এ হল পরিচালনা করা হচ্ছে। হলে কোন সমস্যা নেই। সিটগুলো মেধার ভিত্তিতে দেয়া হয়। ছাত্রীদের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম ছাত্রী নিবাস শামসুন্নাহার হল। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী এ হলে ৭ হাজার ১৪৫ জন ছাত্রীর নামে সিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৬শ' ৮৮ জন আবাসিক, ৬শ ১২ জন দ্বৈতাবাসিক এবং ৫ হাজার ৮শ' ৪৫ জন অনাবাসিক। সব মিলিয়ে বর্তমানে এ হলে বাস করছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ছাত্রী। হলে বসবাসের জন্য রয়েছে মোট ৬টি গণরুম। এসব রুমের প্রতিটিতে ৩০-৩৫ জন করে ছাত্রী বসবাস করে।
হলের ছাত্রীরা জানান, হলের ১৪১, ২৪১, ৩৪১, ৪৪১ ও ৫৪১ নং রুমকে গণরুম করা হয়েছে। এই রুমগুলো রাজনৈতিক নেত্রীরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এছাড়াও হলের ১০২ নং রুমও মিনি গণরুম হিসাবে ব্যবহূত হচ্ছে। আগে ৮ সিটের এই রুমটি বিদেশী ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত থাকলেও এখন সাধারণ ছাত্রীদের বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। হলের বিশাল গেস্ট রুমের একপাশে করা হয়েছে সাইবার সেন্টার। সংকুচিত হয়েছে গেস্ট রুম। মাস্টার্সের ছাত্রীদেরও ডাবলিং করতে হয় ।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক নাজমা শাহীন ইত্তেফাককে বলেন, হলে ধারণ ক্ষমতার বেশি ছাত্রীকে সিট বরাদ্দ দেয়ার কারণে আবাসন সমস্যা রয়েছে। এ জন্য ডাবলিং'র ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল। এ হলে আবাসিক সিটের সংখ্যা ৫৩৬টি। দ্বৈতাবাসিক সিট ২৬৩। এছাড়াও অনাবাসিক ১ হাজার ৪৩২। এই হলের মোট ছাত্রীর সংখ্যা ২ হাজার ২৩১ জন। দ্বৈতাবাসিকসহ এ হলে বর্তমানে দেড় হাজারের অধিক ছাত্রী বসবাস করছে। এ হলে গণরুমের সংখ্যা ৪টি। প্রতিটি রুমে কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ জন ছাত্রী বসবাস করেন। হলের ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, আবাসন সংকট নিরসন করার লক্ষ্যে হলে শিকদার ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হলেও এটি এখন শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। হলে মশার উপদ্রব অনেক বেশি। হলের ছাত্রী আসমা বলেন, হলের দুইটা পড়ার রুম থাকলেও তাতে ৪০ জনের বেশি ছাত্রী পড়তে পারে না। রাত দেড়টার পরে হলের পড়ার রুম বন্ধ করে দেয়া হয়। এজন্য পরীক্ষার সময় গণরুমে বসবাসকারী ছাত্রীদের মারাত্মক সমস্যা হয়। মৈত্রী হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী বলেন, আমি প্রথম বর্ষের ছাত্রী হওয়ায় এখনো হাউজ-টিউটরদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানি না। তবে এতটুকুই বুঝি যে, তাদের অনেক 'পাওয়ার' আছে। অপর ছাত্রী সুবর্ণা বলেন, সমস্যায় জর্জরিত পুরো হল। ডাইনিংয়ে খাবার খেতে গেলে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। উচ্চদাম, নিম্নমানের খাবার। তাও আবার পরিমাণে এত কম যে, আগে না গেলে সে বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। সহস্রাধিক ছাত্রী হলে থাকলেও মাত্র ৩০ সিটের দুটি রিডিং রুম আছে হলে। হল লাইব্রেরিতে নেই পর্যাপ্ত এবং প্রয়োজনীয় বই।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ফরিদা বেগম ইত্তেফাককে বলেন, শিকদার ভবনটি ছাত্রীদের জন্য। তবে ছাত্রীদের তদারকি করার জন্য সহকারী আবাসিক শিক্ষকদের জন্য কিছু বাসা তৈরি করা হয়েছে। দেড়টার পর ছাত্রীরা পড়াশোনা করে না বলে রিডিং রুম বন্ধ রাখা হয়। তাদের অভিযোগ ঠিক নয়।
মেয়েদের সবচেয়ে ছোট হল হলো বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হলের ৫০৮টি সিটে বসবাস করছে প্রায় ১ হাজার ছাত্রী। হলে ৫টি গণরুম রয়েছে। এর মধ্যে মোহনা নামে একটি গণরুমে ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রী অবস্থান করে। এছাড়াও হলের ১১৯ থেকে ১২২ নং কক্ষ পর্যন্ত গণরুম রয়েছে। প্রতিটি গণরুমে ১৫ থেকে ২০ জন অবস্থান করে। এই হলে ডাইনিংয়ে খাবারের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। হলে বিনোদনের জন্য শুধু একটি টিভি রয়েছে। নেই কোন গেমস রুম। হল প্রভোস্ট ঠিকমতো হলে আসেন না বলে অভিযোগ করেন ছাত্রীরা। ছাত্রীরা বলেন, রুমে দুইটার বেশি কম্পিউটার রাখা যায় না।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক গুলশান আরা লতিফা ইত্তেফাককে বলেন, এখন সবচেয়ে বেশি খেলাধুলা হয় ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে। অন্য হলের চেয়ে এ হল অনেক এগিয়ে। প্রশাসন অনেকটা গতিশীল। খাবারের মান অনেক উন্নত হয়েছে।
ছাত্রীদের বড় একটি অংশ মেসে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয় মেসে। প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তারা। হলের সিট সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে তারা মেসে আশ্রয় নেন। তারপরেও তারা সবসময় থাকেন মানসিক দুশ্চিন্তায়। হলের বাইরে মেসে থাকা কেয়া বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে মেসে আছি। এখনো সিট পাই নি। কবে হলে উঠতে পারবো তার কোন ঠিক নেই।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ইত্তেফাককে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসন সংকটের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। কার্জন হলের পাশে রেলওয়ের জমিতে ১ হাজার আসনবিশিষ্ট ছাত্রী হলের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। শামসুন্নাহার ও জগন্নাথ হলের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ছাত্রী হল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও আরো একটি ছাত্রী হল নির্মাণের চিন্তা-ভাবনা চলছে। এই হলগুলো নির্মিত হলে ছাত্রীদের আবাসিক সংকট অনেকটা কমবে বলে তিনি জানান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন